আদিবাসী জনগোষ্ঠী
ভূমিকা : সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলাদেশেও এমনি ছোট-বড় জাতিসত্তার মানুষ আবহমানকাল ধরে বসবাস করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের অবদান ছিল গৌরবের। এরা সংখ্যালঘু হলেও এদের সংস্কৃতি আমাদের মূল্যবান সম্পদ।
আদিবাসী কী?
আদিম বা প্রাচীন সংস্কৃতিবিশিষ্ট ছোট-বড় অনগ্রসর নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীই হলো আদিবাসী। এরা আধুনিক সভ্যতাকে পুরোপুরি গ্রহণ না করে নিজস্ব স্বকীয়তায় ছোট সমাজ বা গোষ্ঠী গঠন করে অরণ্যে বা এর কাছাকাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে। বাংলাদেশে বাস করে চাকমা, খাসিয়া, তঞ্চঙ্গ্যা, গারো, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, ওরাঁও, মুণ্ডা, হাজং, কোচ, ম্রো, চাক, রাখাইন, মণিপুরীসহ আরও অনেক জাতিসত্তার মানুষ।
গভীর অরণ্যে যেসব আদিবাসীর বাস তাদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই অর্থে আদিবাসীদের অপর নাম পৃথিবীর ‘আদিম বাসিন্দা’। বর্তমান বিশ্বের উন্নত জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরি এসব আদিবাসী। এরা ‘উপজাতি’ হিসেবেই বেশি পরিচিত আমাদের বাংলাদেশে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদিবাসী :
৩০ কোটি আদিবাসী বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে। আমেরিকা ও কানাডার ইন্ডিয়ান, ইনুইট বা এস্কিমো, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী, উত্তর ইউরোপের সামি এবং নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসী এদের মধ্যে অন্যতম। কেক্সিকো, গুয়াতেমালা, পেরু প্রভৃতি দেশে মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই আদিবাসী।
বলিভিয়ায় আদিবাসীর সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ। ফিলিপাইনে প্রায় ৬ কোটি আদিবাসীর বাস। ভারতে আদিবাসীর সংখ্যা ৫ কোটি এবং মায়ানমারে ১ কোটি। বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে ৪৫টি ছোট-বড় জাতিসত্তার প্রায় ২০ লাখ লোক বাস করে।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সরকারি হিসাবে ২৭টি জাতিসত্তার ১২ লাখ ৫ হাজার ৯৭৮ জন আদিবাসীর উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের শ্রেণিবিভাগ :
বাংলাদেশের আদিবাসীদের অঞ্চল ভিত্তিতে দুটো ভাগে ভাগ করা যায় :
- ১. পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহ ও বরিশাল-পটুয়াখালি অঞ্চল;
- ২. বাংলাদেশের বাকি অঞ্চল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা, বরিশাল ও পটুয়াখালিতে আছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, ম্রো, কুকি, লুসাই, খাসি, বনযোগী, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখো প্রভৃতি আদিবাসী। বাকি অঞ্চলে রয়েছে সাঁওতাল, মণিপুরী, গারো, খাসিয়া, হাজং, মুণ্ডা, ওরাঁও প্রভৃতি আদিবাসী। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি : আদিবাসীরা গোষ্ঠী সচেতন। যে-কোনো সমস্যা এরা দলবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে। এদের সমাজকাঠামো নানা রকম।
জনসংখ্যা অনুযায়ী এক-একটি সমাজ ছোট ছোট কয়েকটি দল-উপদলে বিভক্ত। প্রতিটি দলই নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট। নিজস্ব সরকার ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় আদিবাসী সমাজ। এদের শিক্ষা ব্যবস্থার ধরনও নিজস্ব। তবে বৃহত্তর সমাজের ভাষা ও শিক্ষাদীক্ষাও এরা গ্রহণ করে। এদের কোনো কোনো সমাজ মাতৃকেন্দ্রিক। পশুপালন ও কৃষিকাজ আদিবাসীদের প্রধান জীবিকা। জাদু, জড়পূজা, এদের সমাজজীবনের একটি বড় অংশ দখল করে আছে। এ
দের অধিকাংশই বৌদ্ধ ও হিন্দু। কেউ কেউ আবার খ্রিস্টধর্মও গ্রহণ করেছে। সরকার ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তি বা বয়োজ্যেষ্ঠদের ওপর। সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বশীল ব্যক্তির নির্দেশেই হয়ে থাকে। আদিবাসীদের গান, গল্প, উপকথা, বৈচিত্র্যময় নৃত্য, মুখে মুখে চলে আসা গল্প, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সম্ভার আমাদের সংস্কৃতিকে বৈচিত্যময় ও সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা, মারমা, রাখাইন ও মণিপুরীরা শিক্ষাদীক্ষায় তুলনামূলকভাবে অনেক অগ্রসর।
আদিবাসী সম্প্রদায়ে বিরাজমান সমস্যা :
আদিবাসীরা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। ঔপনিবেশিকতাবাদের বিস্তার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জোয়ারে আদিবাসী সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। কমবেশি প্রায় প্রত্যেক দেশেই আদিবাসীরা দরিদ্র্যপীড়িত। যেসব আদিবাসী শহুরে সমাজ সভ্যতায় মিশে গেছে তারা ভাষা, শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
অন্যদিকে যারা আদিভূমিতে রয়ে গেছে তাদের সংস্কৃতি কোথাও কোথাও সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে আদিবাসীদের গড় আয়ু তুলনামূলকভাবে কম। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বেকারত্বের হার ৫ গুণ বেশি। ভারতের আদিবাসীরা বাস করে দরিদ্র্যসীমার নিচে।
আদিবাসীদের প্রধান সমস্যাগুলো হলো :
১. ভূমি ও সম্পদ অধিগ্রহণের ফলে তারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে
২. মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে
৩. অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের বিস্তার ঘটছে
৪. ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে রয়েছে অধিকারহীনতা
৫. সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার
৬. সাংবিধানিক স্বীকৃতিহীনতা।
আদিবাসীদের স্বীকৃতি, জীবনের ওপর তাদের অধিকার, ভূমি ও অরণ্যের ওপর অধিকার, সম্পদের ওপর অধিকার আদিবাসীদের বহুদিনের দাবি।
জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী :
জাতিসংঘ ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৯ আগষ্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। আদিবাসী জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের অঙ্গীকার হিসেবে জাতিসংঘ ১৯৯৫-২০০৪ দশককে আদিবাসীদের জন্য আন্তর্জাতিক দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এই দশকের লক্ষ্য হলো, আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের সমস্যার অবসান ঘটিয়ে তাদেরকে মূল ধারার জনগোষ্ঠীর সমপর্যায়ে নিয়ে আসা। ১৯৯৩ সালের ১৪ থেকে ২৫ জুন ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে আদিবাসী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের বঞ্চনার ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। এতে উন্মোচিত হয়েছে এক নতুন দিগন্ত।
আদিবাসীদের পক্ষ থেকে মানববাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্যে রয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র। আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় তদারকির জন্যে রয়েছে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ। আদিবাসীদের মানবাধিকার সংক্রান্ত সরকারি নীতি পর্যালোচনা, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে আদিবাসীদের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, আদিবাসীদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের এই ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ আদিবাসীদের জন্যে স্থঅয়ী ফোরাম গঠন করেছে। আদিবাসীদের উন্নয়নে গ্রহীত বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়নই এই ফোরামের লক্ষ।
উপসংহার :
আদিবাসীরা এই মাটির প্রথম সন্তান। আদিবাসীদের স্বকীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের এক মূল্যবান সম্পদ। আমরা এদেরই উত্তরসূরি।
তাই এই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আমাদের গৌরব ও অহংকার। তাই আদিবাসীদের সব ধরনের অধিকার দিতে হলে দেশের সরকার এবং সেই সাথে সচেতন সকল নাগরিককে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে হবে।